এক ভদ্র মহিলা পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন পাসপোর্ট করাতে।
অফিসার জানতে চাইলেন-
আপনার পেশা কি?
মহিলা বললেন, আমি একজন মা।
আসলে শুধু মা তো কোনো পেশা হতে পারেনা। যাক আমি লিখে দিচ্ছি আপনি একজন গৃহিণি। মহিলা খুব খুশী হলেন।
পাসপোর্টের কাজ কোনো ঝামেলা ছাড়াই শেষ হলো। মহিলা সন্তানের চিকিৎসা নিতে বিদেশ গেলেন। সন্তান সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসল কয়েক বছর পরে, মহিলা দেখলেন পাসপোর্টটা নবায়ন করা দরকার।
যেকোনো সময় কাজে লাগতে পারে।
আবার পাসপোর্ট অফিসে আসলেন।
দেখেন আগের সেই অফিসার আর নেই।
খুব ভারিক্ষি, দাম্ভিক, রুক্ষ মেজাজের এক লোক বসে আছেন।
যথারীতি ফরম পূরণ করতে গিয়ে
অফিসার জানতে চাইলেন-আপনার পেশা কি? মহিলা কিছু একটা বলতে গিয়েও একবার থেমে গিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন-আমি একজন গবেষক। নানারকম চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করি।
শিশুর মানসিক এবং শারিরীক বিকাশ সাধন পর্যবেক্ষণ করে, সে অনুযায়ী পরিকল্পণা প্রণয়ন করি। বয়স্কদের নিবীড় পরিচর্যার দিকে খেয়াল রাখি। সুস্থ পরিবার ও সমাজ বিনির্মানে নিরলস শ্রম দিয়ে
রাষ্ট্রের কাঠামোগত ভীত মজবুত করি।
প্রতিটি মুহুর্তেই আমাকে নানা রকমের চ্যালেঞ্জের ভিতর দিয়ে যেতে হয় এবং
অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা মোকাবিলা করতে হয়। কারণ আমার সামান্য ভুলের জন্য যে বিশাল ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। মহিলার কথা শুনে অফিসার একটু নড়ে চড়ে বসলেন।
মহিলার দিকে এবার যেন একটু শ্রদ্ধা আর বিশেষ নজরে তাকালেন। এবার অফিসার জানতে চাইলেন আসলে আপনার মূল পেশাটি কি? যদি আরেকটু বিশদভাবে বলতেন। লোকটির আগ্রহ এবার বেড়ে গেলো। আসলে পৃথিবীর গুনি জনেরা বলেন - আমার প্রকল্পের কাজ এতো বেশি দূরহ
আর কষ্ট সাধ্য যে, দিনের পর দিন আঙুলের নখ দিয়ে সুবিশাল একটি দিঘী খনন করা নাকি তার চেয়ে অনেক সহজ।আমার রিসার্চ প্রজেক্টতো আসলে অনেকদিন ধরেই
চলছে। সার্বক্ষণিক আমাকে ল্যাবরেটরি এবং ল্যাবরেটরীর বাইরেও কাজ করতে হয়। আহার,নিদ্রা করারও আমার ঠিক সময় নেই। সব সময় আমাকে কাজের প্রতি সজাগ থাকত হয়। দুজন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অধীনে মূলত আমার প্রকল্পের
কাজ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলছে। মহিলা মনে মনে বলেন দুজনের কাউকে অবশ্য সরাসরি
দেখা যায়না। (একজন হলেন
আমার স্রষ্টা আরেকজন হলো বিবেক) আমার নিরলস কাজের স্বীক্বতি স্বরুপ আমি তিনবার স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছি।
(মহিলার তিন জন কন্যা সন্তান ছিল।)
এখন আমি সমাজবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান আর পারিবারিক বিজ্ঞান এ তিনটি ক্ষেত্রেই একসাথে কাজ করছি, যা পৃথিবীর সবচেয়ে
জটিলতম প্রকল্পের বিষয় বলা যায়।
প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ হিসাবে একটি অটিস্টিক শিশুর পরিচর্যা করে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলছি, প্রতিটি মুহুর্তের জন্য।
"উষর মুরুর ধূসর বুকে,
ছোট্ট যদি শহর গড়ো,
একটি শিশু মানুষ করা
তার চাইতেও অনেক বড়"। অফিসার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মহিলার কথা শুনলেন।
এ যেন এক বিস্ময়কর মহিলা। প্রথমে দেখেতো একেবারে পাত্তাই দিতে মনে হয়নি।
প্রতিদিন আমাকে ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা আবার কোনো কোনো দিন আমাকে ২৪
ঘন্টাই আমার ল্যাবে কাজ করতে হয়।
কাজে এতো বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় যে,
কবে যে শেষবার ভালো করে ঘুমিয়ে ছিলাম কোনো রাতে, তাও আমার মনে নেই। অনেক সময় নিজের আহারের কথা ভুলে যাই।
আবার অনেক সময় মনে থাকলেও সবার মুখে অন্ন তুলে না দিয়ে খাওয়ার ফুরসত হয়না। অথবা সবাইকে না খাইয়ে নিজে খেলে পরিতৃপ্তি পাই না। পৃথিবীর সব পেশাতেই কাজের পর ছুটি বলে যে কথাটি আছে আমার পেশাতে সেটা একেবারেই নেই। ২৪ ঘন্টাই আমার অন কল ডিউটি। এরপর আমার আরো দুটি প্রকল্প আছে।একটা হলো বয়স্ক শিশুদের ক্লিনিক।
যা আমাকে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করতে হয়। সেখানেও প্রতিমুহুর্তে শ্রম দিতে হয়।
আমার নিরলস কাজের আর গবেষণার কোনো শেষ নেই। আপনার হয়তোবা জানতে ইচ্ছে করছে, এ চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প পরিচালনায় আমার বেতন কেমন হতে পারে। আমার বেতন ভাতা হলো- পরিবারের সবার মুখে হাসি আর পারিবারিক প্রশান্তি।
এর চেয়ে বড় অর্জন আর বড় প্রাপ্তি যে কিছুই নেই।এবার আমি বলি,
আমার পেশা কি?
আমি একজন মা।
এই পৃথিবীর অতিসাধারণ এক মা।
মহিলার কথা শুনে অফিসারের চোখ জলে ভরে আসে। অফিসার ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে ওঠেন। নিজের মায়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তিনি খুব সুন্দর করে ফর্মের সব কাজ শেষ করে, মহিলাকে সালাম দিয়ে দরজা
পর্যন্ত এগিয়ে দেন। তারপর নিজের অফিস
রুমে এসে -একটি ধূসর হয়ে যাওয়া ছবি বের করে
-ছবিটির দিকে অপলক চেয়ে থাকেন।
নিজের অজান্তেই চোখের জল টপ টপ করে ছবিটির ওপর পড়তে থাকে।
আসলে "মা" এর মাঝে যেন নেই কোনো বড় উপাধির চমক।বড় কোনো পেশাদারিত্বের করপোরে চকচকে ভাব।
কিন্তু কত সহজেই পৃথিবীর সব মা নিঃস্বার্থ ভাবে প্রতিটি পরিবারে নিরলস শ্রম দিয়ে
যাচ্ছেন। মাতৃত্বের গবেষানাগারে প্রতিনিয়ত তিলেতিলে গড়ে তুলছেন একেকটি মানবিক নক্ষত্র।সেই মা সবচেয়ে খুশি হন কখন জানেন- যখন সন্তান প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে ধনে নয়, সম্পদে নয়, বিত্তে নয়, ঐশ্বর্যে নয় শুধু চরিত্রে আর সততায় একজন খাঁটি মানুষ হয়।
Comments
Post a Comment